ভুল করে ভুল স্বীকার করা সিপিএমের পুরনো স্বভাব, তবুও দিনের শেষে ভাগ্যে লেখা ‘বিধানসভা বামশূন্য’!
গত ৭ই জুলাই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ফেসবুকে একটি লাইভ করে ‘নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি ও আমাদের কাজ’ এই বিষয় নিয়ে নানান কথা বলেন। তাঁর সেই বক্তব্য ছেপে বের হয় গণশক্তির প্রথম পাতায়। এরই কয়েকটা লাইন হল এরকম, “বিজেপি ও তৃণমূল নিয়ে পার্টির অবস্থান, কিছু স্লোগান নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। পার্টির কর্মসূচীগত বোঝাপড়া হল, বিজেপি ও আর কোনও রাজনৈতিক দলই এক না। কারণ বিজেপিকে পরিচালনা করে ফ্যাসিবাদী আরএসএস । কিন্তু নির্বাচনের সময় কিছু বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে যে তৃণমূল ও বিজেপি এক। বিজেমূল জাতীয় স্লোগান, বিজেপি-তৃণমূল মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ-এর মতো স্লোগান বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। আমাদের পার্টির কর্মসূচীগত বোঝাপড়াতেই পরিস্কার, বিজেপি ও তৃণমূল একেবারেই সমান নয়”।
গণশক্তির রিপোর্ট বলছে, পার্টির যে সমস্ত স্লোগান দিয়েছে, তা যে ভুল তা সূর্যকান্ত মিশ্র স্বীকার করেননি। তিনি এ স্বীকার করেননি যে দলের কর্মী-সমর্থকদের দলের নেতৃত্ব রাজনৈতিক পথ দেখাতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের দেশে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে যে ভুল করা ও ভুল স্বীকার করা, এতেই জর্জরিত সেই পার্টি। অন্য কোনও পার্টি কিন্তু এভাবে ভুল করে ভুল স্বীকার করে না।
এই ধরুন বিজেপি। ভোটের আগে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এত ফলাও করে ঘোষণা করে গেল যে বিজেপি ২০০ পার করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রশান্ত কিশোরের ভবিষ্যৎবাণীই ঠিক হল। বিজেপি ১০০ও পেরোতে পারল না। কিন্তু তা বলে কী আর কেউ নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহ্’কে কাঠগড়ায় তুলছে? না তো? এদিকে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের উপরও ক্ষোভ এল না।
আসলে বিজেপিতে দিলীপ ঘোষ ফুটবলের ক্যাপ্টেনের মতো। সবকিছু পরিচালনা করে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। ম্যাচ জিতলে সবাই ক্যাপ্টেনের জয়জয়কার করে। কিন্তু হারলে আঙুল ওঠে টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের দিকে। তাই দিলীপ ঘোষ এদিকে থেকে সেফ। আর মোদী-শাহ্দের দিকে আঙুল তুলবে, এমন সাহস কার আছে, তাই বিজেপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট পর্যালোচনার বৈঠক আর হয়নি।
অন্যদিকে, কংগ্রেসও একটা কমিটি তৈরি করে ফলাফল বিশ্লেষণ করছে বলে জানা গেলেও, তা যে কোথায় হচ্ছে, তা কারোর জানা নেই। এদিক থেকে সিপিএম প্রশংসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে বইকি। ভুল করে ভুল স্বীকার করার মতো একটা ভালো কাজও কিন্তু তবে মাঝেমধ্যে অতি বিরক্তকর হয়ে ওঠে যখন তা স্বভাবে পরিণত হয়।
একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক ২০০০ সালে। সেই সালের মাঝামাঝি সময়ের একদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী কলকাতায়। তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন তৎকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। বাজপেয়ী ও বসু দুই আলাদা রাজনৈতিক ঘরানার মানুষ হলেও, তাদের মধ্যে সখ্যতা ছিল নিবিড়। সেই সময় বাজপেয়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে এসে জ্যোতি বসু এক জনসভায় বলেন যে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি তাদের দলকে বর্বর, অসভ্য বলেন কেন? সেই উত্তরে জ্যোতি বসু বলেছিলেন যে তিনি তাঁকে বলেননি। বলেছেন তাঁর দলকে। যে দল বাবরি মসজিদের মতো একটি প্রাচীন ইমারত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়, সেই দলকে আর কীই বা বলা যেতে পারে। সেবারও কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা বিজেপির কেউ এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করে বলেননি যে বসু মিথ্যে বলছেন।
এবার আসা যাক, ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে। সেই সময় সোশ্যাল মিডিয়া গল্প মাত্র। সেই সময় প্রচার হত পুরোটাই সভা, মিছিল করে। সেবছরই প্রথম নির্বাচন কমিশন বাংলায় ভোটের জন্য এক বিশেষ পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেন। বিহারের আমলা আফজল আমানুল্লা আসেন রাজ্যে পর্যবেক্ষক হয়ে। পর্যবেক্ষণ করে তিনি কমিশনে জানান যে বাংলার অবস্থা বিহারের চেয়েও খারাপ। আমানুল্লার আসা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় সিপিএম নেতা বিমান বসুর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়।
সে বছর প্রথম রাজ্যের তিন পুলিশকে ভোটের আগে সরিয়ে দেয় কমিশন। এমনকি, রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের উপর আস্থা রাখতে পারেনি কমিশন। তাই অসম ও ঝাড়খণ্ড থেকে বাঙালি কর্মচারী ন্যগ করা হয় বুথে। এই সময় সিপিএম ভেবেছিল, তাদের ফল ভালো হবে না। তাই আগেভাগেই জ্যোতিবাবু স্থির করেন যে নির্বাচনের পর তারা কংগ্রেসের নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ দল গড়বে। কিন্তু ভোটের ফলাফল হয় উল্টো। সিপিএম জিতে যায় ৩৫টি আসনে। সেই সময়ও নিজেদের ভুল স্বীকার করে সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বইয়ে লেখেন, “পার্টির নেতা হওয়া, জনগণের নেতা হওয়াই কঠিন”।
সেই ঝলকই দেখা যায় ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে। আসলে, সিপিএম বরাবরই সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছে ভোটের আশায়। এই কারণে তারা আগেও বিজেপির কথা মাথায় রেখেই সংখ্যালঘু প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের পাশে থেকেছে। আর তাই এবারেও বামেদের ভোটে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে আরও বেশি স্পষ্ট হওয়া উচিত ছিল। আসলে, তারা বিজেপিকে রুখতে নয়, বরং তৃণমূলকে হারাতেই উদ্যোগী ছিল।
এই কারণে আইএসএফের সঙ্গে জুটি বাঁধে সংখ্যালঘু ভোটের উদ্দেশ্যে। তাহলে সংখ্যালঘু ভোট যদি তাদের দিকে যায়, তাহলে কী বিজেপিকে রাজ্যের বাকী ভোট পাওয়ানোতে সুবিধা করে দেওয়া হল না? এবারের আসলে নিজেদের সরকার গড়তে নয়, তৃণমূলের পতনের জন্যই ময়দানে নামে বামেরা। তাহলে বিজেপির নামে এত ফলাও করে বিরোধী স্লোগান না দিয়ে, তৃণমূলকে আরও বেশি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা উচিত ছিল না কী? আসলে, বামেরা এখনও মেনে নিতেই পারেনি যে দশ বছর আগেই এক নেত্রী তাদের ৩৪ বছরের শাসনকালের অবসান ঘটিয়েছিল। এই কারণেই বিধানসভা বামশূন্য এমন দিনও দেখতে হল তাদের।