যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত প্রেমিকা আকাঙ্খা শর্মা ও নিজের বাবা, মাকে খুনে ধৃত উদয়ন দাস।
২০১৭ সালের একটি খুনের ঘটনা হাড়ে হিমস্রোম বইয়ে দেয়। ২০১৭ সালে বাঁকুড়ার বাসিন্দা আকাঙ্ক্ষা শর্মা (২৮)-এর দেহ উদ্ধার হয় ভোপালের সাকেত নগরে তাঁরই প্রেমিকের বাড়িতে একটি সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বেদির নীচে। এই ঘটনায় পরেই গ্রেফতার হয় উয়দন দাস। নামে ওই প্রেমিক। খুন, অপহরণ, দেহ ও তথ্য লোপাটের মামলার দোষী সাব্যস্ত হয় অভিযুক্ত। সেই সিরিয়াল কিলার উদয়ন দাসকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল বাঁকুড়া ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট। মঙ্গলবার আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। প্রেমিকা আকাঙ্খা শর্মা এবং নিজের বাবা বীরেন্দ্রনাথ দাস ও মা ইন্দ্রানী দাসকে খুন করার অপরাধে এই সাজা দিল আদালত।
সরকারি আইনজীবী জানিয়েছেন, খুনের ঘটনায় উদয়ন দাসকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন বিচারক। সেই সঙ্গে ২০ হাজার টাকা জরিমানা। অনাদায়ে আরও ২ বছরের জেল। তথ্য লোপাটের ঘটনায় ২ বছরের জেল। ২ হাজার টাকা জরিমানাও ধার্য করা হয়েছে। উদয়নের আইনজীবী জানান, তাঁরা উচ্চ আদালতে যাবেন। আকাঙ্ক্ষার পরিবার জানিয়েছে, তাঁরা এই অপরাধের ফাঁসি চেয়েছিলেন।
২০১৭ সালে আকাঙ্খা শর্মা খুনের ঘটনায় রীতিমত তোলপাড় হয় দেশ জুড়ে। সূত্রের খবর ২০০৮ সালে সোশ্যাল মিডিয়ায় উদয়নের সঙ্গে পরিচয় হয় আকাঙ্খা শর্মার। ইংরেজিতে তুখোর উদয়ন নিজেকে আমেরিকার একটি মাল্টি ন্যাশনাল সংস্থার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে দাবি করে। আকাঙ্খাকে আমেরিকায় ইউনিসেফে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার নাম করে দিল্লিতে ডেকে নিয়ে যায় উদয়ন। ইউনিসেফে চাকরির একটি নিয়োগপত্রও পাঠিয়েছিল উদয়ন।
পুলিসের তদন্তে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ২৩ জুন দিল্লিতে পৌঁছন আকাঙ্খা। সেখানে গিয়ে আকাঙ্খা জানতে পারে ওই নিয়োগপত্র সম্পূর্ণ ভুয়ো। আকাঙ্খা বিষয়টি জানিয়েছিল তাঁর পরিবারকে। দিল্লি যাওয়ার পর শুরুর দিকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও ধীরে ধীরে আকাঙ্খার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয় পরিবারের। পরবর্তীতে টেলিফোনে কথাবার্তা না হলেও নিয়মিতভাবে বাড়িতে মেসেজ আসতে থাকে আকাঙ্খার মোবাইল থেকে।
পরবর্তীতে পুলিশের জেরায় উদয়ন জানায় আকাঙ্খা দিল্লি পৌছানোর পর সেখান থেকে তারা যান ভোপালে। ২০১৬ সালের ২৭ জুন ভোপালের একটি কালী মন্দিরে আকাঙ্খাকে বিয়ে করে উদয়ন। উদয়নের সঙ্গে থাকতে গিয়ে প্রেমিকের স্বরূপ জানতে পারেন আকাঙ্খা। ভুল ভাঙতেই বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরু করেন আকাঙ্খা।
২০১৬ সালের ১২ জুলাই বাঁকুড়ায় নিজের বাড়িতে ফেরার জন্য উদয়নকে লুকিয়ে অনলাইনে ট্রেনের টিকিটও নাকি কাটেন আকাঙ্খা। বিষয়টি জানতে পেরেই ১৫ জুলাই আকাঙ্খাকে শ্বাসরোধ করে খুন করে উদয়ন। এরপর মৃতদেহ টিনের বাক্সে ভরে ভোপালের ঘরের মধ্যেই সিমেন্টের বেদি তৈরি করে লুকিয়ে ফেলে।
প্রেমিকাকে খুনের পরই তাঁর পরিবারের হাওয়া বুঝতে ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর আকাঙ্খার বাঁকুড়ার বাড়িতে আসে উদয়ন। আকাঙ্খার পরিবারকে জানায় তাঁদের মেয়ে আমেরিকায় রয়েছেন। প্রয়োজনে সেখানে গিয়ে তাঁরা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। ভিসার জন্য আকাঙ্খার মা বাবাকে দিল্লিতে যাওয়ার কথাও বলে উদয়ন।
পরে উদয়নের কথা মতো দিল্লি যায় আকাঙ্খার বাবা ও দাদা। কিন্তু দিল্লিতে যাওয়ার পর আর উদয়নের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অগত্যা বাড়ি ফিরে আসেন আকাঙ্খার বাবা ও দাদা। এরপরই পরিবারের সন্দেহ বাড়ে উদয়নের ওপর। এরপর আকাঙ্খার বাবা ও দাদা ভোপালের সাকেতনগরে আকাঙ্খার খোঁজে গেলেও কোনও সন্ধান পাননি। এতেই সন্দেহ আরও তীব্র হয়।
এরপর ২০১৬ সালের ৫ই ডিসেম্বর আকাঙ্খার বাবা শিবেন্দ্র নারায়ন শর্মা বাঁকুড়া সদর থানার দ্বারস্থ হয়ে নিখোঁজ ডায়েরি করেন। এরপরই তদন্তে গতি আসে। পরিবার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে, শেষ পর্যন্ত ৫ ডিসেম্বর বাঁকুড়া সদর থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করে। মোবাইল লোকেশন থেকে জানা যায়, ভোপালের সাকেতনগর থেকে মেসেজ করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের ৫ই জানুয়ারি উদয়নের বিরুদ্ধে আকাঙ্ক্ষাকে অপহরণের মামলা করেন তাঁরা।
ওই বছরেরই ১লা ফেব্রুয়ারি ভোপালে গিয়ে বাঁকুড়া পুলিশ উদয়নকে গ্রেফতার করে। উদ্ধার হয় আকাঙ্ক্ষার দেহাবশেষ। এর পর জেরায় পুলিশ জানতে পারে, উদয়ন তাঁর নিজের বাবা বীরেন্দ্রকুমার দাস ও মা ইন্দ্রাণী দাসকেও ২০১০ সালে খুন করে ছত্তীসগঢ়ের রায়পুরের বাড়ির বাগানে পুঁতে দিয়েছে। ৫ই ফেব্রুয়ারি উদয়নের বলার পর তাঁদের কঙ্কাল উদ্ধার হয়। এমনটাও মনে করা হয় এই হত্যাকাণ্ডের কথা জেনে গিয়েছিলেন আকাঙ্খা।